বাংলা নাটকের ‘অভি’মুখ বদলাচ্ছে, অশোকনগর নাট্যমুখের ‘হাও মাচ ইস ইওর আয়রন’-এ রাগের আগুন

Advertisement

বাংলার নাটকেও সারা বছর ধরে চলছে ব্রেখট যাপন৷ বিভিন্ন দলের উদ্যোগে একাধিক বের্টোল্ট ব্রেখটের নানা নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে কলকাতা শহরের বিভিন্ন মঞ্চে৷ নতুন করে উঠে এসেছে গবেষণার নানা দিক৷ নাৎজি জার্মানির বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ স্বরকে কেউ কেউ ভারতের বর্তমান সময়ে এসে একসঙ্গে মিলিয়ে দেখতে চাইছেন৷ সে দেখা ঠিক না ভুল, তা শিল্পের নানন্দিকতার বিষয়৷ কিন্তু এসবের মধ্যে বাংলার নাটকের এক অদ্ভুত সংযোগ স্থলে এসে ব্রেখটকের নবনির্মাণ এক আঙ্গিক খুলে দিচ্ছে চেতনার৷ দর্শককে নাড়া দিচ্ছে, ভাবাচ্ছে৷

অশোকনগর নাট্যমুখ দীর্ঘ পথ পেরিয়ে এসেছে৷ সেই যাত্রা পথে নানা সময়ে বিভিন্ন স্বাদের নাটক উঠে এসেছে৷ কিন্তু এই নাটক সময়ের প্রয়োজন৷ আলোচকের সঙ্গে ব্যক্তিগত কথায় একথা বলেছেন পরিচালক অভি চক্রবর্তীও৷ মধুসূদন মঞ্চে সম্প্রতি মঞ্চস্থ হল ব্রেখটের নাটক অবলম্বনে ‘হাউ মাচ ইস ইওর আয়রন’৷ লোহার দাম কত? লোহা আসলে কী? কিসের লোহা? কেন হঠাৎ লোহার দামের দিকে ঝুঁকলেন পরিচালক ও অভিনেতা সেই সঙ্গে নাট্য সংগঠক, অভি চক্রবর্তী৷ নাটক দেখলেই সেই বিষয়টি স্পষ্ট করে ধরা পড়ে৷

লোহার দোকানদার৷ ব্যবসার দিকেই তাঁর নজর শুধু৷ কিন্তু ইদানিং তাঁর ব্যবসা ভাল চলছে না৷ বরং সেখানে একের পর বিপত্তি এসে উপস্থিত হয়৷ বিভিন্ন ধর্মের গুণ্ডারা এসে হাজির হয়, টাকা চায়৷ কিন্তু তার মধ্যে এক ধর্মের ধ্বজাধারী এসে উপস্থিত হন, নিয়মিত ক্রেতা হিসাবে৷ তিনি ক্রমে, ক্রমে, সময়ের সঙ্গে বাড়াতে থাকেন লোহা কেনার পরিমাণ৷ গল্পের বাকিটুকু দেখতে হলে পৌঁছতে হবে মঞ্চের সামনে৷ সমালোচনা মানে তো গল্পটা পুরোটা আলোচনা নয়৷ আমরা সেই অভ্যাস বাদই রাখছি, বরং আমরা কথা বলি ফর্ম নিয়ে৷

নাটক চমকে দেবে

মঞ্চের নির্মাণে অভি চিরকালই অভিনবত্ব রাখেন অভি চক্রবর্তী৷ এ বারেও তার থেকে আলাদা কিছু হয়নি৷ বরং এ বারেও মঞ্চে ছিল অভিনবত্ব৷ মঞ্চের প্রতিটি অংশের নিজস্ব অর্থ আছে, আর সেগুলো আলাদা করে বোঝানো নাটকের পরিচালকের দায়িত্ব৷ কখন কী ভাবে, মঞ্চের কোন অংশকে কোনও অভিনেতা ছোঁবেন, তা নির্বাচন করেন পরিচালক৷ সেটি নৈপুন্যের সঙ্গে করেছেন পরিচালক৷ অভিনয়ের কথাও আলাদা করে বলতেই হয়৷ কারণ, অভিনয়ের একটা সুপ্ত ভাষা নির্মাণ একান্ত নিজস্ব ঢঙে এখানে তৈরি করেছেন অভি৷ নাটকের চরিত্র, মানে বেশিরভাগ চরিত্রের কথা বলার ধরণ উচ্চস্বরে৷ স্বাভাবিক ভাবে মানুষ তো এমন করে কথা বলে না৷ এতটা চেঁচিয়ে কেউ কথা বলে? না, তা হলে?

এতটা স্টাইলাইজ অভিনয়ের ধরণ কেন পছন্দ করলেন পরিচালক অভি৷ নাটক যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা বুঝতে পারবেন, যে বিষয়বিস্তু নিয়ে কথা বলে, সেখানে তীব্রতা রয়েছে হিংসার৷ সাম্প্রতিক সময়ে দাঁড়িয়ে ভারত তথা বিশ্বের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সচেতন নাগরিকদের বাধ্য করে বারংবার হিংসা নিয়ে বেঁচে থাকতে৷ আর সেই হিংসার চারদিককেই এ ভাবে মেনে নিয়েছি আমরা, মানে এই নাটকের দর্শকরা৷ আর সেই কারণেই নাটকের অভিনয়ে এই উচ্চগ্রামের সংলাপ প্রতিস্থাপন একান্ত জরুরি হয়ে পড়ে৷ অভিনেতারা সকলেই এই ভূমিকা সঠিক ভাবে পালন করেছেন৷ তবে আরও একটি কথা বলা দরকার, নাটকটি বাংলা ভাষায় ব্রেখটকে গ্রহণ করার পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ব্রেখটের নাটকের দর্শনকেও ভোলেননি পরিচালক অভি৷ নাটকের একটি অংশে লোহার দোকানের মালিক হঠাৎ সংলাপের ধারা থেকে ছিটকে গিয়ে এক মৃত্যুর প্রসঙ্গে টেনে আনেন গৌরী লঙ্কেশের মৃত্যুর প্রসঙ্গ৷ নাটকের অন্দর থেকে ‘এলিয়েনেশন’-এর তত্ত্বে উত্তরিত হয় এই নাটক৷

নাটকে যথার্থ অভিনয় করেছেন অরুপ গোস্বামী, স্বাগতম হালদার, সুকান্ত পাল, গৌতম বসুরা৷ তবে এই নাটকে অভিনয় করতেন পরিচালক অভি চক্রবর্তী, তার বদলে এই দিন অভিনয় করেছেন ঋভু চক্রবর্তী আর আলিম সাহেব চরিত্রে অভিনয় করেছেন সুদীপ্ত ভুঁইয়া৷ নাটকে মিউজিক ও প্রোডাকশনের কাজ করেছেন প্রীতম শর্মা ও তমাল মুখোপাধ্যায়৷ মঞ্চ নির্মাণ করেছেন অরুণ মণ্ডল, যা এক কথায় অনবদ্য৷ সব মিলিয়ে নাটকের বিভিন্ন দিক এই প্রযোজনাকে কার্যত স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছে৷

Published by:Uddalak B

First published:

Tags: Bengali Theatre

Advertisement

Malek

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।