শিক্ষা দুর্নীতি কাণ্ডে গ্রেফতার শান্তনু
শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে জানুয়ারির ২০ তারিখ ম্যারাথন তল্লাশি চালায় ইডি। এরপর গতকাল পর্যন্ত মোট সাত দফায় চলে জিজ্ঞাসাবাদ। তারপর গ্রেফতারি। কলেজে পড়ার সময় থেকেই ছাত্র রাজনীতির মধ্যে দিয়ে উত্থান শান্তনুর। জিরাটে বলাগড় বিজয়কৃষ্ণ মহাবিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। বাবার মৃত্যুর পর বিদ্যুৎ দফতরের কর্মরত ছিলেন।

ছাত্র রাজনীতি থেকে ধাপে ধাপে যুব সংগঠনের রাজ্যস্তরে
ছাত্রাবস্থা থেকেই নাট্যাভিনয়ে যুক্ত ছিলেন। প্রথমে হুগলি জেলায় তৃণমূল যুবার দায়িত্ব পান। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় তৃণমূল যুব কংগ্রেসের সভাপতি হওয়ার পর শান্তনুকে হুগলি জেলার তৃণমূল যুব কংগ্রেস সভাপতি করা হয়। সেখান থেকেই পৌঁছে যান রাজ্যস্তরের সংগঠনে। শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি ফেসবুজ পেজের প্রোফাইল পিকচারে রয়েছে অভিষেকের সঙ্গে তাঁর ছবি।

প্রভাবশালী নেতা
২০২০ সালে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় তৃণমূল যুব কংগ্রেসের যে কমিটি গড়েছিলেন তাতে সভাপতি অভিষেকের পর সহ সভাপতিদের নামের তালিকায় সোহম চক্রবর্তীর পরই দ্বিতীয় স্থানে নাম ছিল শান্তনুর। এতেই বোঝা যায় তিনি অভিষেকের কতটা ঘনিষ্ঠ, কতটা প্রভাবশালী। বাংলার যুবশক্তি কর্মসূচিতে শান্তনুকে একাধিক জেলার পর্যবেক্ষক করা হয়।

হুগলি জেলা পরিষদের কর্মাধ্যক্ষ
শান্তনুকে অবশ্য তৃণমূল যুব কংগ্রেসের সহ সভাপতির পদ থেকে সরতে হয় এক ব্যক্তি এক পদ নীতির জন্য। সায়নী ঘোষ তৃণমূল যুব কংগ্রেসের সভানেত্রী হওয়ার পর। যে জেলার যুব সংগঠন একার হাতে সামলাতেন শান্তনু, সেই জেলাকেই শান্তনুর অনুপস্থিতিতে একাধিক সাংগঠনিক জেলাতে ভাঙতে হয়েছে। শান্তনু বর্তমানে হুগলি জেলা পরিষদের জনস্বাস্থ্য কর্মাধ্যক্ষ। যদিও ইডি তদন্ত শুরুর পর থেকে শান্তনুকে দলের কাজ করতে দেখা যায়নি।

শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা
বলাগড়, জিরাটের বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, শান্তনুর বাড়িতে এসেছিলেন খোদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। পরেও একবার জিরাটে নির্বাচনী জনসভা করতে অভিষেক এসেছিলেন, তখনও তাঁর কাছাকাছিই দেখা গিয়েছে শান্তনুকে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একাধিক সভাতেও শান্তনু মঞ্চে ছিলেন। তাঁর ফেসবুকেও সেই সব ছবি রয়েছে।

তদন্ত শুরুর পরই বদলায় চিত্র
চন্দননগরের বিধায়ক ইন্দ্রনীল সেনের নির্বাচনী প্রচারেও সামনের সারিতে দেখা গিয়েছে শান্তনুকে। যদিও শান্তনু ঘনিষ্ঠ মহলে আক্ষেপের সুরেই বলেন, ইডি আমাকে যখন জিজ্ঞাসাবাদ করেছে আমি তার সম্মুখীন হয়েছি। কিন্তু একবারের জন্যও দলের কেউ আমার পরিবারের সদস্যদের খোঁজটুকু নেওয়ার সৌজন্য দেখাননি। উল্টে বিজেপি-সহ বিরোধীরা সুর চড়ানোর আগে তৃণমূলের একাংশ (যাঁরা শান্তনুর বিরোধী শিবির বলে স্থানীয় স্তরে পরিচিত) শান্তনু ও তাঁর পরিবারের উপর নানাভাবে চাপ তৈরি করতে চেয়েছে।

তৃণমূলের একাংশ উল্লসিত!
শান্তনুর ঘনিষ্ঠরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানাচ্ছেন, ‘দাদা’র গ্রেফতারির পর থেকে তৃণমূলের একাংশই বেশি উচ্ছ্বসিত। এমনকী ইডি তদন্ত শুরুর পর থেকে শান্তনু-ঘনিষ্ঠদের তৃণমূল কংগ্রেসের তরফেই নানাভাবে হেনস্থা হতে হচ্ছে বলেও অভিযোগ। এক যুব নেত্রীই এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা নিচ্ছিলেন বলে অভিযোগ। বলাগড়ের বিধায়ক মনোরঞ্জন ব্যাপারী তো বলেই দিয়েছেন, শান্তনু-সহ কয়েকজনের সঙ্গে তাঁর মনোমালিন্য ছিল।

দল ছাড়ার ভাবনা?
জানা যাচ্ছে, সামগ্রিক পরিস্থিতি দেখে কয়েকদিন আগে তৃণমূলের এক মুখপাত্রর কাছে শান্তনু দুঃখপ্রকাশ করে বলেছিলেন, যে দলের জন্য এত করলেন, সেখান থেকে যা প্রাপ্তি হলো তাতে এবার তিনি নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবেন। রাজনীতি করলেও এই দল করবেন না। যদিও ওই মুখপাত্র এমন পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকতে বলেন। উল্লেখ্য, শান্তনু বিজেপিতে যোগ দিতে পারেন বলে গত বিধানসভা নির্বাচনের আগেও চর্চা ছিল। যদিও তিনি দলবদল করেননি।

দূরত্ব বজায় রেখে চলছে দলীয় নেতৃত্ব
শান্তনুর ঘনিষ্ঠ মহল সূত্রে জানা গিয়েছে, গতকাল রাতে গ্রেফতারির পর এই প্রতিবেদন লেখা অবধি দলের কোনও স্তর থেকে কেউই যোগাযোগ করেননি। একে অনেকেই মনে করছেন বিপদে পড়া শান্তনুকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে। অবশ্য তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে এখনও কড়া কোনও বিবৃতি জারি হয়নি, শান্তনুকে কোনও পদ থেকে সরানোও হয়নি। যেমন কুন্তলও এখন বহাল তবিয়তে দলীয় পদে রয়েছেন। শান্তনু এদিন ব্যাঙ্কশাল আদালতে যাওয়ার পথে তুলে ধরেছেন ফাঁসানোরই সেই তত্ত্ব।

ইডির তদন্তে সহযোগিতার আশ্বাস
ইডি গতকালের আগে পর্যন্ত শান্তনুকে ৬ বার জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল। ঘনিষ্ঠ মহলে শান্তনু বলেছিলেন, ইডি আধিকারিকরা খুব ভালো ব্যবহার করেছেন। আমি তাঁদের সবরকম সহযোগিতা করব। তদন্তের বিষয় বিস্তারিতভাবে জনসমক্ষে না আনলেও শান্তনুর দাবি ছিল, ইডি তাঁর কাছে একটাই বিষয় জানতে চেয়েছেন, দুর্নীতির টাকা কোথায় গিয়েছে? শান্তনুর দাবি তিনি ইডিকে জানান, আমি নিজে এই দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত নই। তাই কোথায় টাকা গিয়েছে জানি না।

কুন্তলকে চিনলেও দুর্নীতির দায়ভার নিতে অস্বীকার
কুন্তল ঘোষকে চেনেন কিনা সেই প্রশ্নের উত্তরে তদন্তকারীদের শান্তনু জানান, বলাগড়ের বাসিন্দাকে কুন্তলকে চিনি না বলা ভুল হবে। তবে তিনি যদি কোনও দুর্নীতি করে থাকেন তার দায় আমার নেওয়ার প্রশ্ন নেই। কুন্তলের সঙ্গে শাসক দলের শীর্ষস্তরের এক যুবনেত্রীর ঘনিষ্ঠতার বিষয়ে অবশ্য শান্তনু-ঘনিষ্ঠরা অনেকেই অবহিত।

সম্পত্তি নিয়ে চর্চা
শান্তনুর সম্পত্তি নিয়েও চলছে চর্চা। যদিও শান্তনু তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলে জানিয়েছিলেন, ইডি সূত্র বলে সংবাদমাধ্যমে যে সব বলা হয় তা নিয়ে জানতে চেয়েছিলাম তদন্তকারী আধিকারিকদের কাছে। তাঁরা বলেন, তদন্তের কথা আমরা বাইরে বলি না। তাঁর সম্পত্তির নথিতে তদন্তকারী আধিকারিকরা সন্তুষ্ট বলেও জোরালো গলায় দাবি করেছিলেন শান্তনু।

তদন্তে কীভাবে অসহযোগিতা?
রাজনৈতিক মহলের ধারণা, তদন্তে অসহযোগিতার যে কথা বলা হচ্ছে তা হতে পারে, টাকা কোথায় কোথায় গিয়েছে? তদন্তকারীদের সেই সংক্রান্ত প্রশ্নে শান্তনুর নীরবতাই গ্রেফতারির বড় কারণ। তদন্তকারীদের ধারণা হতে পারে শান্তনু জেনেশুনে কোনও এক বা একাধিক ব্যক্তিকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। শান্তনু এদিন নিজেকে নির্দোষ দাবি করে আদালতেই সব কিছু বলবেন বলে জানান। শান্তনুর গ্রেফতারিতে তদন্তের অভিমুখ এখন কোনদিকে গড়ায় সেদিকেই তাকিয়ে সকলে। বিজেপি-সহ বিরোধীরা অবশ্য দাবি জানাচ্ছে, চুনোপুঁটি না ধরে কাতলা মাছের মাথাই আগে চাই!